প্রিন্ট এর তারিখঃ নভেম্বর ২১, ২০২৪, ৬:২১ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ মার্চ ১২, ২০২৪, ৯:৫৩ পূর্বাহ্ণ
রাজশাহী জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগে প্রকাশ্যে বিভক্তির সুত্রপাত হয়েছে। রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের সাংসদ আব্দুল ওয়াদুদ দারাকে গণসংবর্ধনা দেয়া নিয়ে এই বিভক্তির সুত্রপাত হয়েছে বলে একাধিক সুত্র নিশ্চিত করেছে। স্থানীয়রা জানান,
আওয়ামী লীগে এই বিভক্তির জন্য তৃণমুল অভিযোগের তীর ছুড়েছে মহানগর আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতার দিকে। যিনি দলের দায়িত্বশীল এবং গুরুত্বপুর্ণ পদে থেকেও দল, নেতা ও নেতৃত্বের সঙে বেঈমানি এবং বিভিন্ন সংসদীয় আসনে নৌকা ডোবাতে তৎপর ছিলেন। তার প্রত্যক্ষ মদদে জেলার বিভিন্ন সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগবিরোধীরা সংগঠিত হয়েছে।
জানা গেছে, রাজশাহী মহানগরীর সাহেববাজার বড় মসজিদ চত্বরে গত শনিবার বিকালে জেলা আওয়ামী লীগ ও মহানগর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে গণসংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। কিন্ত্ত জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অনিল কুমার সরকার, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কামাল ও আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য এবং সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, রাজশাহী-৩ আসনের সাংসদ আসাদুজ্জামান আসাদ এবং রাজশাহী-২ (সদর) আসনের স্বতন্ত্র সাংসদ ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শফিকুর রহমান বাদশা উপস্থিত ছিলেন না।
রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের সাংসদ আলহাজ্ব ওমর ফারুক চৌধুরীর সভাপতিত্বে আয়োজিত গণসংবর্ধনায় বক্তব্য রাখেন- রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সাংসদ আবুল কালাম আজাদ, রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সাবেক সাংসদ আয়েন উদ্দিন, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর ইকবাল, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার প্রমুখ। এছাড়াও মুঠোফোনের মাধ্যমে ঢাকা থেকে বক্তব্য দেন রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনের এমপি শাহরিয়ার আলম। অনুষ্ঠানে যারা বক্তব্য দিয়েছেন তাঁদের প্রত্যেকেরই বক্তব্যে দলীয় বিভক্তি সামনে এসেছে বলে মনে করছেন জৈষ্ঠ নেতারা।
রাজশাহী-৪ আসনের এমপি আবুল কালাম আজাদ তো বক্তব্য দিতে গিয়ে তাঁর নিজ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অনিল কুমার সরকারের প্রকাশ্যেই সমালোচনা করেছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিল কুমার সরকার দলের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী এনামুল হকের কাঁচি প্রতীকের পক্ষে সরব ছিলেন। সে কথা তুলে ধরে এমপি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘কাঁচির অত্যাচারে নৌকার নেতা ও কর্মী-সমর্থকগণ অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল ভাই। এই এলাকার যারা হ্যাডাম নেতা, তারা গিয়ে বলে- “উমুক ভাইয়ের সালাম নিন, কাঁচি মার্কায় ভোট দিন। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এদেরকে বলতে চাই, একজন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নৌকার বিপক্ষে কাঁচিতে ভোট করে কি করে ! এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী স্বাগত বক্তব্য বলেন, ‘আজ থেকে রাজশাহী জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ মুক্ত বলে ঘোষণা করা হলো। রাজশাহীর আকাশে যে আমবশ্যা ছিল, সব সময়ই আমবশ্যা, সব সময়ই সূর্যগ্রহণ-আজকে থেকে আর কোনো সূর্যগ্রহণ রাজশাহীর আকাশে কাজ করবে না। আমরা করতে দিবো না। আমরা আওয়ামী লীগকে সমস্ত রকম অন্যায়-অবিচার থেকে মুক্ত ঘোষণা করলাম। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দেশকে স্বাধীনতার জন্য, ভাসানির আন্দোলন করার জন্য। আওয়ামী লীগ আজকে সকল মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়া হলো এবং একে (রাজশাহী) মুক্ত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হলো। আওয়ামী লীগের নেতাকমীরা মাথা উঁচু করে চলবে। কারণ জননেত্রী শেখ হাসিনা এদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তিনি ছাড়া আর কোনো বাঘ আমরা দেখতে চাই না। আমরা আজকে প্রথম ‘ট্রায়াল’ করলাম এবং এরপরে আমরা আরও অনেক কিছু দেখাব বলে প্রত্যাশা করছি। প্রতিমন্ত্রী আবদুল ওয়াদুদ দারা বলেন, ‘ফারুক ভাই বললেন রাজশাহী জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ আজ মুক্ত হলো। কেন ? বললেন এ কথাটি তার সারমর্ম রয়েছে। কী এমন রাজনৈতিক নেতা (সংসদ নির্বাচনে দারার প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী) আমার আসনে নৌকার বিরুদ্ধে এত ভোট পায় ? তার রাজনৈতিক পরিচয় কি ? একটাই কারণ তার টাকা আর তার পেছনে রাজনৈতিক মহাশক্তি। পুঠিয়া-দুর্গাপুরে কে আছে এত যোগ্য ? আমি নিজের কথা বলছি না। দুঃখে, কষ্টে, যন্ত্রণায় বলছি। আমার পুঠিয়া-দুর্গাপুরের বহু নেতাকে এই শহরের কিছু নেতা মুনাফেক বানিয়েছে, বেঈমান বানিয়েছে, চরিত্রহনন করেছে। আর তা হবে না। জেলা আওয়ামী লীগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জৈষ্ঠ বলেন,এই আয়োজন থেকে রাজশাহী আওয়ামী লীগ পরিবারতন্ত্র হতে মুক্তির সু-বাতাস পাচ্ছে।
স্থানীয় পর্যবেক্ষক মহলের অভিমত, রাজশাহীর মহানগরীর এক প্রভাশালী নেতা দল, নেতা ও নেতৃত্বের সঙ্গে বেঈমানী করে দলের ভিতরে বিভক্তি সৃষ্টি করেছেন, এই দায় তার। তিনি জেলা পরিষদ, পৌরসভা, ইউনিয়ন (ইউপি) এমনকি সদ্য সমাপ্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার পরাজয় নিশ্চিত করতে নেপথ্যে থেকে প্রাষাদ ষড়যন্ত্র ও কলকাঠি নেড়েছেন।এছাড়াও বিভিন্ন সংসদীয় আসনে নৌকার পরাজয় নিশ্চিত করতে নৌকাবিরোধীদের সেল্টার দিয়েছেন। তার নেপথ্যে মদদে নৌকাবিরোধীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নৌকার বিপক্ষে ভোট প্রয়োগ করেছেন বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা। আগামিতে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার ও নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করতে তার বিকল্প নেতৃত্ব দাবি করেছেন।
এদিকে অনুষ্ঠানে না থাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজশাহী-৩ আসনের এমপি আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, এই গণসংবর্ধনার ব্যাপারে আমাকে কেউ কিছু জানায়নি। দলের ক্ষুদ্র একটি অংশকে নিয়ে এই ধরনের গণসংবর্ধনা দলকে বিভক্ত করেছে। নিশ্চয় এই খবর দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যাবে।’এবিষয়ে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘কেউ চিঠি দিয়ে কিংবা মোবাইল ফোনের মাধ্যমেও আমাকে এই গণসংবর্ধনার বিষয়ে জানায়নি। গণসংবর্ধনায় জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতিরাই ছিলেন না। দলের খণ্ডিত একটা অংশ এই গণসংবর্ধনা করেছে। তারা সামান্যতম রাজনৈতিক সৌজন্য বা ভদ্রতায় শহীদ কামারুজ্জামানের ছবিটাও ব্যবহার করেনি। তারা গণসংবর্ধনার নামে দলের ভেতরের গ্রুপিং দেখালেন। এর জন্য প্রধানমন্ত্রী কাউকে প্রতিমন্ত্রী করেননি। এটা তারা কী করল- ভবিষ্যতই তার উত্তর দেবে। মহানগর আওয়ামী লীগের মূল স্রোত তো আমরাই। ৯৫ শতাংশ তো আমাদেরই সঙ্গে।’ গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এলাকার এমপি আবুল কালাম আজাদের প্রকাশ্যেই গালিগালাজ করার বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অনিল কুমার সরকার বলেন, ‘দল এবার দলীয় প্রতীকের জন্য কাজ করা বাধ্যতামূলক করেননি, আমিও করিনি। এই জন্য তিনি প্রকাশ্যেই গালাগাল করলেন, এটা মোবাইলে দেখলাম। এটা তাঁর স্বভাবজাত অভ্যাস। তিনি প্রায়ই সন্ত্রাসী কায়দায় কথাবার্তা বলেন। আমি তো মারামারি করতে পারি না।এবিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলার সভাপতি আহমেদ সফিউদ্দিন বলেন, ‘রাজশাহীর উন্নয়নের স্বার্থে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ঐক্যবদ্ধ থাকা দরকার। তা না করে দলীয় বিভক্তি নিয়ে এই ধরনের গণসংবর্ধনার অনুষ্ঠান সাধারণ মানুষের কাছে অনৈক্যের বার্তা গেল।